
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূমিকা ‘উপসাম্রাজ্যবাদ’ বলে চিহ্নিত করা যায়। এ কথা বলেছিলেন এ. জি. ফ্রাঙ্ক। এ অঞ্চলে ভারতের যে ভূমিকা তাকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। বৃহত্তর পর্যায়ে ভারতের উদ্ভব ও বিকাশের কারণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে দেশটির আধিপত্যবাদী ভূমিকা দেখা যায়। সে জন্য দেশটির সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সম্পর্ক খারাপ। দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ভারত নিয়ে ক্ষোভ চোখে পড়ে। এখন ভারত সরকারের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সরকারের বিরোধও আমরা দেখতে পাচ্ছি। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ প্রায় সবক’টি পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আজ অবনতির দিকে। অনেক দিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে এই বৈরী সম্পর্ক চলমান।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার দীর্ঘদিন ভারত সরকার কিংবা ভারতের শর্তে ও স্বার্থে ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে হাসিনা সরকার বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর অনেক চুক্তি ভারতের সঙ্গে করেছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত সরকার তার একটা বড় অবলম্বন হারানোর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে; যার ফলে তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে চলে গেছে। এটি খুবই অকূটনৈতিক ব্যবহার, যেখানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র সম্পর্কে বৈরী ধারণা বা ভূমিকা দেখা যাচ্ছে।
এটি আরও বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। ভারতের মধ্যেই দলটির বিরুদ্ধে অনেক লড়াই ও সংগ্রাম রয়েছে, তাদের ফ্যাসিবাদী ধ্যানধারণা ও নিপীড়নমূলক ভূমিকা ও খুবই আগ্রাসী তৎপরতার কারণে। বিজেপির বিরুদ্ধে সেখানে বামপন্থি ও সংখ্যালঘু মানুষদের গণতন্ত্রপন্থি অংশ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কৃষক, শ্রমিকরাও লড়াই-সংগ্রাম করছে। বর্তমানে ভারত সরকারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে কিছু বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে আদানি অন্যতম। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে মোদি সরকার আশপাশের দেশ, আফ্রিকা ও অন্যান্য দূরবর্তী দেশগুলোকে এমন সব চুক্তি করতে বাধ্য করছে, যেগুলো দেশগুলোর স্বার্থের প্রতিকূল। বাংলাদেশে আদানি চুক্তি হলো তার একটি উদাহরণ। কিংবা সুন্দরবন বা রামপাল প্রকল্প আরেকটি উদাহরণ।
ভারতের এ ধরনের ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, সেটিকে দেশটি একটি সাম্প্রদায়িক চেহারা দিতে চেয়েছে। তারা বলতে চায়, এটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কিংবা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া, অথবা তাদের সাম্প্রদায়িক প্রতিবাদ। এটি মোটেও ঠিক নয়। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ক্ষোভের বস্তুগত ভিত্তি রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো সীমান্ত হত্যা, যা ক্রমাগত চলছে। হাসিনা সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো থাকলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ ছিল না। এখনও তা চলছে। ফারাক্কা, তিস্তার বাইরেও তারা একচেটিয়াভাবে বিভিন্ন রকম বাঁধ করছে। তাতে বাংলাদেশের কৃষি ও প্রতিবেশগত অনেক ক্ষতি হচ্ছে। ট্রানজিট নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো খুবই অস্বচ্ছ। আর সর্বশেষ হাসিনা সরকার রেলওয়ে, বন্দর নিয়ে যেসব সমঝোতা ও চুক্তিতে এসেছে, সেগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
এর বাইরে আছে অসম বাণিজ্য ও ভারতের সঙ্গে করা প্রকল্পগুলো, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপনে বাধা সৃষ্টি ইত্যাদি। তাদের একচেটিয়া খবরদারির আরেকটা হচ্ছে বাংলাদেশে আমরা তাদের মিডিয়া ও চ্যানেলের সবক’টির ভোক্তা। হাসিনা সরকারের সঙ্গে এত বেশি ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ভারতে অনুমোদন পায়নি। ফলে ভারতের মানুষ বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা কিংবা বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত লড়াই, তাদের আকঙ্ক্ষা, ক্ষোভ কোনো কিছু সম্পর্কে জানে না। ভারতের মিডিয়া একচেটিয়াভাবে একটা সাম্প্রদায়িক প্রচারের মধ্যে থাকে। সেটির ওপর ভর করে ভারত সরকার নানা রকম ভূমিকা পালন করে। হাসিনা সরকারের পতনের পর সেটিই এখন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের কোনো সমালোচনা করলেই তারা দাবি করে, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। এ কথাটা বলার অর্থ হলো, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতামূলক ভূমিকা থাকায় বাংলাদেশের জনগণ তার কোনো সমালোচনা করতে পারবে না। রাষ্ট্রের কোনো দয়ামায়া, সহানুভূতি থাকে না। রাষ্ট্র কৌশলগত ও স্বার্থে বিভিন্ন রকম ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে ভারত রাষ্ট্র সেভাবেই ভূমিকা পালন করেছিল। জনগণের মধ্যে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, কিংবা আবেগ কাজ করে। বিশেষত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের জনগণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, বাংলাদেশি বিপুল শরণার্থীর দায়িত্ব যেভাবে তারা নিয়েছিল, তার জন্য অবশ্যই আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকতে হবে এবং স্বীকৃতি দিতে হবে।
কিন্তু ১৯৭১ সালে বিজেপি নামক কোনো দল ছিল না। আর মোদির ভূমিকাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার সহযোগিতা করেছে বলে মোদি সরকারের ইচ্ছামতো তৎপরতা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। এ সমস্যাগুলো সমাধানে আলোচনার পথ ভারত সরকারই বন্ধ করে দিয়েছে। তারা পানি সমস্যার সমাধানে কোনো রকম আলোচনায় বসতে চায় না। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে চায় না এবং আরও বেশি বেশি একচেটিয়া ট্রানজিট ও অন্যান্য সুবিধা তারা পেতে চায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারত সরকারের থাকার কারণে আরও জটিলতা বেড়েছে। আর হাসিনা সরকার পতনের পরে সমস্যাটা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
আমাদের বুঝতে হবে, ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধ হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব নয়। ভারত রাষ্ট্রের এই অবস্থান ঠিক হিন্দু রাষ্ট্রের ভূমিকা নয়। এটি হচ্ছে বৃহৎ রাষ্ট্র কিংবা বৃহৎ পুঁজির একটি আগ্রাসী ভূমিকার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে তারা হিন্দুত্ববাদকে ব্যবহার করছে। ভারতকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের অনেক তথ্য ও সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো সামনে আনতে হবে। আমাদের দাবি পরিষ্কারভাবে তোলা উচিত, রামপাল ও সুন্দরবনের মতো যেসব প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর, সেই চুক্তিগুলো বাতিল করা। এ দাবিটি জনগণের মধ্যে পরিষ্কারভাবে আসা দরকার। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার জন্য জোর দাবি তোলা উচিত। পানি সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনের ওপর ভর করে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করা উচিত, যেহেতু ভারত সেটির সমাধানে এগিয়ে আসছে না।
সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে আমাদের যেসব সামরিক, বেসামরিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি বিশেষত গত ১৫ বছরে হয়েছে– সেগুলো পুরোপুরি প্রকাশ করা। যেসব চুক্তির মধ্যে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে, সেগুলো বাতিলের ব্যবস্থা করা। সঙ্গে এটিও মনে রাখতে হবে, ভারতের জনগণও বিজেপি সরকারের নানা রকম জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতার শিকার। সুতরাং ভারতের জনগণের সঙ্গে আমাদের একটা সুসম্পর্ক রাখতে হবে। ভারতের জনগণসহ দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে একটি সংহতি তৈরি করতে হবে, যাতে ভারত রাষ্ট্রে আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের জনগণের মধ্যে একটি ঐক্য গড়ে ওঠে। ভারতের জনগণ যাতে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্রটা বুঝতে পারে তার জন্য দুই দেশের জনগণের মধ্যে যে ঐক্যসূত্র বা অভিন্ন জায়গা আছে, সেগুলো সামনে এনে আমাদের লড়াইকে দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: লেখক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক