
বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে তহবিল আত্মসাৎ করেছেন যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি ও সাবেক ট্রেজারি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিক। সেই অর্থ দিয়ে তিনি লন্ডনে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ।
টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি জানায়, টিউলিপ, তার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মা শেখ রেহানা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত রূপপুর প্রকল্প থেকে ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করেছেন। সেই অর্থের ৭ লাখ পাউন্ড দিয়ে লন্ডনে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন টিউলিপ। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণও পেয়েছে দুদক।
টিউলিপ সিদ্দিক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাব খাটিয়ে নানা সময়ে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে ব্রিটেনে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ফ্ল্যাট গ্রহণেরও (উপহার) অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কেইর স্টারমারের নৈতিকতাবিষয়ক উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাস তদন্ত করে দেখেছেন যে, টিউলিপ এই কেলেঙ্কারি (ফ্ল্যাট কেনা) সম্পর্কে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দিয়েছেন। এরপরই লেবার পার্টির নেতৃস্থানীয় পদ থেকে তাকে ইস্তফা দিতে হয়েছে।
ট্রেজারি মিনিস্টারের পদে থাকার সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব ছিল টিউলিপের। কিন্তু লন্ডনে নিজের ব্যবহৃত সম্পত্তি এবং সেগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তিনি নিজেই এ বিষয়ে তদন্ত করার আহ্বান জানান।
টিউলিপ, শেখ হাসিনা ও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত করছে দুদক। এই তদন্তে ব্রিটিশ তদন্ত সংস্থাও (এনসিএ) সহায়তা করছে বলে জানা গেছে।
তদন্তের সর্বশেষ আপডেটে দুদক জানিয়েছে, অভিযোগের ভিত্তিতে তারা জানতে পেরেছে, লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ড মূল্যের বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট টিউলিপ সিদ্দিক পেয়েছেন। দুদকের অনুমান, এটি বাংলাদেশের ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে আত্মসাৎ করা অর্থে কেনা হয়েছে।
তদন্তকারীরা দাবি করেছেন, এই অবৈধ অর্থ মালয়েশিয়ার অফশোর ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে লন্ডনে হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের জন্য উচ্চমূল্যের সম্পত্তি কেনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টেলিগ্রাফকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘গোপন অনুসন্ধানে এসব অভিযোগ সত্য বলে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা প্রকাশ্য তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিক দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, তিনি বাংলাদেশে তার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত অর্থ পাচার ও অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’
সূত্রটি আরও বলেছে, অফশোর ব্যাংক হিসাব ও সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রেও টিউলিপের নাম উঠে এসেছে, যা অবৈধ অর্থের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দুদক জানিয়েছে, শুধু টিউলিপ সিদ্দিকই নন, তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও লন্ডনে বিভিন্ন বাড়ি বা ফ্ল্যাট পেয়েছেন, যার মধ্যে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড মূল্যের একটি ফ্ল্যাট এবং উত্তর লন্ডনে ১৫ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ড মূল্যের একটি বাড়ি উল্লেখযোগ্য।
তদন্তকারীদের দাবি, এসব লেনদেন আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং চক্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ এখন এই সম্পদের প্রকৃত অর্থের উৎস তদন্ত করছে। তবে এটি এখনো স্পষ্ট নয়, এগুলো সেই একই সম্পত্তি কি না, যা স্যার লরি ম্যাগনাস তদন্ত করেছিলেন।
লেবার পার্টির সূত্র জানিয়েছে, ২০০৪ সালে এক ব্যবসায়ী টিউলিপ সিদ্দিককে যে ফ্ল্যাটটি উপহার দিয়েছিলেন, সেটির বর্তমান মূল্য ৭ লাখ পাউন্ড। কিন্তু এটি রূপপুর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৩ সালে।
টিউলিপ সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘এ ক্ষেত্রে সময়সীমা মিলছে না। টিউলিপ সিদ্দিকের বিদেশে কোনো সম্পত্তি বা ব্যাংক হিসাব নেই।’ স্যার লরি ম্যাগনাসও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো অস্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।’