
নিজস্ব প্রতিবেদক, নোয়াখালী
নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার তিনটি উন্নয়ন কাজের কোটি টাকার ইজিপি টেন্ডার থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মাহমুদুর রহমান রিপন নামে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব। এদিকে কাজের অনুমতি ছাড়াই জেলা পরিষদের সরকারি ঘাটলা খুলে নিয়ে যাচ্ছেন কাজ কেনা কথিত ওই ঠিকাদার।
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) সরেজমিনে কোম্পানীগঞ্জ গিয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরসঙ্গে পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর ফরহাদ শামিম, উপজেলা প্রকৌশলী কাজী কামরুল ইসলাম ও বসুরহাট পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইয়াছিন জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরের আরসিসি সড়ক ৪১ লাখ ১৯ হাজার ৪০৯ টাকা, জেলা পরিষদের বসুরহাট ডাকবাংলো গাইডওয়াল ও আরসিসি সড়ক ৩১ লাখ ২৭ হাজার ১৭২ টাকা, পৌরসভা ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কোম্পানীগঞ্জ মডেল হাইস্কুল (কেজি) সংলগ্ন আরসিসি ড্রেন, হইদ বাড়ি থেকে মোফাজ্জল সড়ক আরসিসি এবং ২ নম্বর ওয়ার্ড কালামিয়া সওদাগরের পুরাতন বাড়ি আরসিসি সড়ক ৩৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪০৬ টাকাসহ মোট এক কোটি ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮৭ টাকার ইজিপি টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
এতে ১৪ জন ঠিকাদার অংশগ্রহণ করেন। এরা হলেন, দেলোয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স স্বপন ট্রেডার্স, তিশা এন্টারপ্রাইজ, রহমান বাণিজ্য সংস্থা, রব এন্টারপ্রাইজ, এনএস ডিস্ট্রিবিউশন, রাজু এন্টারপ্রাইজ, মাহমুদ এন্টারপ্রাইজ, বাবলু এন্ড ব্রাদার্স, মোহন ট্রেডার্স, এসএম এন্টারপ্রাইজ, দিপন এন্টারপ্রাইজ ও হামিদ এন্টারপ্রাইজ। এরমধ্যে হামিদ এন্টারপ্রাইজকে বাতিল ঘোষণা করা হয়।
গত ১৯ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় ইজিপি টেন্ডার লটারীর সময়ও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারদের ডেকে সময়মতো লটারী না করে সমঝোতায় কাজ বিক্রির প্রস্তাব দেন উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান রিপন। তিনি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লটারী বন্ধ রেখে টেন্ডারের মৌখিক ডাক তোলেন। এতে শিবলু নামে এক ঠিকাদার ১৫ শতাংশ টাকায় কাজগুলো কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে বিকেল ৫টায় লোক দেখানো লটারী করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
এতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরের আরসিসি সড়কের কাজ পান মোহন ট্রেডার্স, জেলা পরিষদের বসুরহাট ডাকবাংলো গাইডওয়াল ও আরসিসি সড়কের কাজ রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ এবং পৌরসভা ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কোম্পানীগঞ্জ মডেল হাইস্কুল (কেজি) সংলগ্ন আরসিসি ড্রেন, হইদ বাড়ি থেকে মোফাজ্জল সড়ক আরসিসি এবং ২ নম্বর ওয়ার্ড কালামিয়া সওদাগরের পুরাতন বাড়ি আরসিসি সড়কের কাজ স্বপন ট্রেডার্সের নাম লটারীতে উঠে। কিন্তু লটারীপ্রাপ্ত ঠিকাদারদেরকে কাজ করতে বারণ করে টাকা বুঝে নিয়ে জনৈক শিবলুকে কাজগুলো করতে বলেন বিএনপির নেতা মাহমুদুর রহমান রিপন।
মঙ্গলবার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঠিকাদার শিবলু তার লোকজন দিয়ে বসুরহাট ডাকবাংলোর সরকারি ঘাটলা খুলে ইট-সুরকি নিয়ে যাচ্ছেন। পৌরসভা থেকে কাজ করার অনুমতি না দিলেও বিএনপি নেতার নিয়োগ করা কথিত ঠিকাদার শিবলু পৌরসভার কাজ শুরু করেছেন বলে জানান। ঘাটলা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পৌরসভার কাজগুলো টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। আর ঘাটলা খুলে নিতে ইউএনও-প্রকৌশলী আমাকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তোভোগী এক ঠিকাদার বলেন, বসুরহাট পৌরসভার এ কাজগুলো শুরুতেই পাঁচ শতাংশ কমে টেন্ডার নেওয়া হয়। তার উপর বিএনপির নেতা নিয়ে গেলেন ১৫ শতাংশ এবং সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ১৫ শতাংশ বাদ দিয়ে অফিসের খরচ দিতে হয় আরও পাঁচ শতাংশ। এরপর ১০ শতাংশ ঠিকাদারের জামানত। মোট ৫০ শতাংশ টাকা এখনি বাদ গেল আর সঠিক কাজ করার সুযোগ কোথায়?
বসুরহাট ডাকবাংলোর কাজ পাওয়া রিয়াদ এন্টারপ্রাইজের মালিক রিয়াদ হোসেন বলেন, আমার লাইসেন্সে পাওয়া কাজটি আমি করছি না। এটি উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান রিপন নিয়ে গেছেন। এখন কাজটি তিনি করছেন নাকি বিক্রি করে দিয়েছেন তা আমর জানা নাই। অন্যদিকে ঠিকাদার শিবলু বলেন, আমি টাকা দিয়ে কিনে এখন কাজগুলো করার চেষ্টা করছি।
অভিযুক্ত বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমান রিপন কাজ বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমার লোক দিয়ে রিয়াদ এন্টারপ্রাইজের নামে লটারী দিয়ে একটি কাজ পেয়েছি। কাজটি আমি ১৫ শতাংশ টাকা নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমার কাজ আমি বিক্রি করে দিলে দোষ কোথায়?’ তিনটি কাজ ১৫ লাখ টাকায় বিক্রির তথ্য জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির এ নেতা বলেন, 'আপনার সঙ্গে সাক্ষাতে আলাপ করবো।'
বসুরহাট পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইয়াছিন দাবি করেন, ইজিপি টেন্ডার স্বচ্ছ সুন্দরভাবে লটারী করে প্রাপ্ত ঠিকাদারদেরকে কাজ করার অনুমতির প্রক্রিয়া চলছে। বাহিরে কে কি করলো তা আমাদের জানা নাই। শিবলু কে তাকে আমরা চিনি না যারা কাজ পেয়েছেন তাদের নামেই কাজের অনুমতি দেওয়া হবে। আর ঘাটলা খুলে নিতে বলার বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারে নাই।
উপজেলা প্রকৌশলী কাজী কামরুল ইসলাম বলেন, আমি বসুরহাট পৌরসভার টেন্ডার কমিটির সদস্য কিন্তু কাজর ব্যাপারে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। স্বচ্ছতার জন্য ইজিপিতে টেন্ডার লটারী করা হয়। এতে কোন অনিয়ম হলে তা খতিয়ে দেখা হবে।
পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর ফরহাদ শামিম বলেন, ইজিপি টেন্ডার বিক্রি করার সুযোগ নাই। যার নামে লটারীতে কাজ উঠেছে তাকেই করতে হবে। অন্যথায় কাজ বাতিল করা হবে। দেরিতে লটারী দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে ডাকবাংলোর ঘাটলা খুলে নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নাই। জেলা পরিষদের কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।
জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মো. সামছুল আলম বলেন, জেলা পরিষদের বসুরহাট ডাকবাংলোর ঘাটলা কারা খুলে নিচ্ছে তা আমার জানা নাই। আমাদের এসব মালামাল বিক্রি করতে হলে টেন্ডারের মাধ্যমে করতে হবে। আমরা সেরকম কোনো টেন্ডার দেইনি। এটিতো হরিলুটের মাল নয় যে যার ইচ্ছা নিয়ে যাবে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।